গুণাবলিঃ শিক্ষক শব্দের আভিধানিক অর্থ শিক্ষা কারক,বিদ্যাগ্রহীতা। শিক্ষকের দায়িত্ব সমাজের আর দশজন কর্মীর চেয়ে স্বতন্ত্র এবং তাৎপর্যপূর্ণ। শিক্ষকতার প্রধান শর্তগুলো হচ্ছে-
১.শিক্ষকতা বৃত্তির প্রতি প্রীতি ও শ্রদ্ধাবোধ,
২. ছাত্রদের প্রতি সহানুভূতিশীল মনোভাব,
৩. শিক্ষণীয় বিষয়ের প্রতি অনুরাগ এবং নিষ্ঠা।
মাতৃভাষার সাহায্যে ছাত্র-ছাত্রীদের বৃহত্তর জীবনের জন্য প্রস্তুত করে তোলার পূর্বে তাই শিক্ষক-শিক্ষিকাগণ নিজেরা প্রস্তুত হবেন। এই প্রস্তুতি যত সার্থক ও সুন্দর হবে,মাতৃভাষা শিক্ষাদান তত বেশি সহজ,আনন্দদায়ক ও ফলপ্রসূ হয়ে দেখা দিবে। ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষকের যোগ্যতা ও গুণাবলি সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হলো-
১.ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষকও প্রথমে শিক্ষক,কাজেই তাঁকে উপর্যুক্ত তিনটি বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হতেই হবে।
২.আমাদের শিক্ষার মাধ্যম যেহেতু মাতৃভাষা,সে জন্য ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষকের মাতৃভাষা সম্বন্ধে পর্যাপ্ত জ্ঞান ও দক্ষতা থাকতে হবে,যাতে তিনি অপর ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষককেও প্রয়োজনবোধে সাহায্য করতে পারেন।
৩. সাতৃভাষা একটি জীবন্ত ও ক্রমবর্ধমান ভাষা। এ ভাষার উন্মেষ এবং ক্রমবিবর্তনের ইতিহাস শিক্ষককে অবশ্যই জানতে হবে;ভাষার ধ্বনিরূপ,শব্দরূপ এবং বাক্যরীতি সম্বন্ধে তাঁর বিশেষ জ্ঞান থাকা চাই। মাতৃভাষার ধারাবাহিক ইতিহাস সম্পর্কে অজ্ঞ শিক্ষকের পক্ষে মাতৃভাষার শিক্ষকের দায়িত্ব নেয়া উচিত নয়।
৪.মাতৃভাষা শিক্ষকের দৃষ্টিভঙ্গি উদার,নিরপেক্ষ অথচ সূক্ষ্ণ এবং স্বচ্ছ হতে হবে। তিনি নিজ ভাষা ছাড়াও সাহিত্য চর্চার জন্য আরও দু’চারটি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করবেন।
৫. মাতৃভাষার শিক্ষকের অবশ্যই তাঁর কর্তব্যের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য এবং সুদূর প্রসারী গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন হয়েই তৎপর হতে হবে।
৬. মাতৃভার শিক্ষকের উচ্চারণ,সরবপঠন এবং দ্রুত অথচ সুন্দর লিখন ক্ষমতা,নির্ভুল ও যথাযথ হওয়া একান্ত প্রয়োজন।
৭. তিনি কল্পনা প্রবণ,পাঠানুরাগী এবং অধ্যবসায়ী হবেন। অধ্যয়নের বেলায় একজন উত্তম ছাত্রের পাঠানুরাগ তাঁর থাকা চাই।
৮. তিনি সৌন্দর্য সচেতন,মার্জিত রুচি সম্পন্ন ব্যক্তি হবেন। সুন্দর শব্দ,সুন্দর বাক্য,সুন্দর উদ্ধৃতি এবং সুন্দর বাচনশৈলী তাঁর অন্তরকে স্পর্শ করবে।
৯. ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষকের অভিধান দেখার অভ্যাস যেমন থাকবে,তেমনি ব্যাকরণ চর্চায়ও সযত্ন অনুরাগ থাকা চাই।
১০. শ্রেণি পাঠনার সময় প্রশ্ন করার কৌশল তাঁর আয়ত্তাধীন থাকবে,পাঠ বিশ্লেষণের সময় পাঠ উপাদানের ব্যবহারেও তিনি কুশলী শিল্পীর পরিচয় দিবেন।
১১.শ্রেণি পাঠনায় শিক্ষক নমনীয় মনোভাব গ্রহণ করবেন। পাঠ শিক্ষায় শিক্ষক ও ছাত্রের মধ্যে দাতা ও গ্রহীতার সম্পর্ক থাকবে না; বন্ধু এবং সহযোগীর অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে,যাতে পাঠদান ও পাঠগ্রহণ সহজ,স্বাভাবিক এবং আনন্দময় হয়ে ওঠে।
১২. শিক্ষককে অবশ্যই মানসিক প্রসন্নতার,সুমধুর ব্যক্তিত্বের,নিরপেক্ষতার এবং শিক্ষাদানে নমনীয় মনোভাবের অধিকারী হতে হবে।
পরিশেষে বলা যায়,মাতৃভাষার শিক্ষক শিক্ষিকাগণ জীবন ও কর্তব্য কর্মে আন্তরিক এবং নিষ্ঠাবান হবেন। তাদের চারিদিকে সারাক্ষণ একটি আনন্দময় প্রশান্তি বিরাজ করবে এবং তাদের মধুর ও আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের দ্বারা তাঁরা এমন একটি নিরাপত্তার নিশ্চিত ভাব পরিবেশ সৃষ্টি করবেন,যার প্রভাবে ছাত্র-ছাত্রীগণ আপনাদের নিরাপদ বলে সহজেই মনে করতে পারে। শিক্ষকের জীবনের আদর্শ এবং তাঁর জীবনাদর্শের সংক্রমণ-শিক্ষার্থীর চিত্তে ঘটবে নিম্নলিখিত বাণীরই সূত্রে
“আমার যেন না হয় প্রচারে
আমার আপন কাজে;
তোমার ইচ্ছা করো হে পূর্ণ
আমার জীবন মাঝে।“- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
উপর্যুক্ত গুণাবলির উৎকর্ষ সাধনের উপায়ঃ নিজেকে প্রকাশ করতে পারার মধ্য দিয়েই ভাষা শিক্ষার চরম উৎকর্ষ ঘটে। ভাষার সুষ্ঠু ও যথাযথ ব্যবহারের যোগ্যতা অর্জন করা শিক্ষকের জন্যে একান্ত কাম্য। এক্ষেত্রে সাধু ও চলিত রীতির ব্যবহার সম্পর্কে শিক্ষকের পরিস্কার ধারণা থাকা বাঞ্ছনীয়। বানান ও উচ্চারণ অনুশীলন এবং এ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে শিক্ষকের।
পাঠ উপস্থাপনের ক্ষেত্রে শুদ্ধ উচ্চারণে কথা বলা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ,বলা ও পড়া বিষয়ে শিক্ষককে কাঙ্খিত যোগ্যতাটি অর্জন করতে হবে এবং পড়ায় তা যথাযথভাবে প্রয়োগ করতে হবে। পঠন,আবৃত্তি এবং সংলাপ উচ্চারণে তিনি হবেন একজন নিপুণ শিল্পি,আর তা আয়ত্তের জন্যে শিক্ষককে অধ্যবসায়ী হতে হবে।
উপকরণের মাধ্যমে পাঠ উপস্থাপন করতে হবে। এক্ষেত্রে শিক্ষক বিভিন্ন উপকরণ যেমন- কবি সাহিত্যিকদের ছবি,চার্ট,কার্ড,ফ্লানেল বোর্ড ইত্যাদি প্রস্তুত করে তার উপকরণ ভান্ডার সমৃদ্ধ করবেন।
শিক্ষকের গভীর ভিষয় জ্ঞান থাকতে হবে। আর এ জন্যে প্রয়োজন প্রস্তুতি। বিষয়ের চলমান অবস্থা সম্পর্কে তাঁকে ধারণা রাখতে হবে।
শব্দ,উপমা,রূপক ইত্যাদি সম্পর্কে শিক্ষকের স্পষ্ট ধারণা থাকা বাঞ্ছনীয়।তাঁকে সাহিত্যানুরাগী হতে হবে। শিক্ষক যদি সাহিত্য পাঠে নিজেকে ব্যপৃত রাখেন,শিক্ষার্থীও তাকে অনুসরণ করবে।
শিক্ষাদানের অন্যান্য রীতি পদ্ধতি সম্পর্কেও শিক্ষককে বিশেষভাবে অবহিত হতে হবে।
উৎস:বাংলা শিক্ষণ(ইডিবিএন1521)বাউবি
No comments:
Post a Comment